দুই হাতে লেখা

লারা | ডিসেম্বর 20, 2009

১ …

সেদিন ক্যাফের সামনে বসে বসে আড্ডা পিটাচ্ছি। কথায় কথায় একজন বললো, আমি ইদানিং খুব বই টই পড়তেছি, তারপর কেমন যেন বদলে টদলেও যাচ্ছি, মুখ দিয়ে খ্রাপ কথা বের হয় না তেমন একটা। আমি মিটিমিটি হাসি। সবগুলো সত্য না হলেও প্রথমটা মোটামুটি সত্যি।

কলেজে অনেক বই পড়েছি, কারণ বিনোদনের একমাত্র উৎস ছিল বই। প্রেপে গল্পের বই, একাডেমি টাইমে গল্পের বই, শুক্রুবারের অলস দুপুরে গল্পের বই। তারপর আইইউটিতে এসে পিসি সর্বস্ব জীবন গ্রহণ করার পর বই পড়ার অভ্যাস জলাঞ্জলি গেল তুরাগের জলে। ল্যানে মাল্টিপ্লেয়ার গেমস, ফাঁকে ফাঁকে ভালো কিংবা সামাজিক চলচ্চিত্র, প্রচুর পরিমানে ঘুম এই সব কিছুর মধ্যে আমার বই পড়ার অভ্যেসটা স্রোতের অনুকূলে ভেসে যেতে থাকলো অনেক অনেক দূরে।

দ্বিতীয় বর্ষের শেষদিকে যখন ব্লগ নামক এক জগতের সন্ধান পেলাম তখন বাংলা পড়ার অভ্যাস একেবারেই শেষ। তাই প্রথমদিকে আমার ব্লগ পড়া মানেই মন্তব্য করবো এই উদ্দেশ্যে লেখার উপর দিয়ে হালকা উড়ে যাওয়া। উড়ে যেতে যেতেই অভ্যাসটা ফিরে এলো আবার, বাংলা পড়ার অভ্যাস। কিন্তু তা শুধু ব্লগেই। আমি পুরোদস্তুর ব্লগ পাঠক হয়ে গেলাম, প্রিন্টেড বই হাতের কাছে তেমন একটা পাইনা, পেলেও পড়ার ধৈর্য্য থাকে না, শ’ শ’য়ে পাতা দেখে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলি, একটা সময় ছিল যখন এক কি দুই দিনে তিন চারশ পাতা পড়ে ফেলতে পারতাম।

আমার খুব প্রিয় একজন ব্লগার আছেন। অসম্ভব সুন্দর গল্প লিখেন। মাঝখানে তিনি লাপাত্তা অনেকদিন। আগে প্রতিদিন একটা করে অসম্ভব ভালো গল্প লিখে ভাসিয়ে দিতেন সব কিছু এখন আর তিনি লিখেন না। ছয় মাস পর তার সাথে দেখা হলো, বললাম, এতোদিন কোথায় ছিলেন? জবাবে তিনি জানালেন, সব বাদ দিয়ে বই পড়েছেন। পৃথিবীতে এতো এতো ভালো বই আছে, এতো এতো ভালো লেখা আছে অথচ জীবনটা বড় ছোট্ট। তিনি এই জীবনটা বই পড়েই কাটিয়ে দিতে চান, যতটা সম্ভব।

গুরু টাইপ মানুষ। আমারও মনে হলো তাই তো। এই লোক কত বই পড়ে এই কথা বললেন, আর আমি তো ছানাপোনা, বলার মতো কিছুই পড়ি নাই। ঠিক করলাম আমিও আবার শুরু করবো। স্বপ্নবাজ মানুষ আমি, স্বপ্ন দেখেই ক্ষ্যামা দেই, স্বপ্নপূরণ কর্মে ঝাঁপাই না পারতপক্ষে। কিন্তু এইবার সিরিয়াস। বই মেলা থেকে কিছু বই কিনলাম। আড়াই হাজার টাকা দিয়ে মাস চালাতে হয়, সুতরাং বাক্সভর্তি বই কেনার সামর্থ্য নেই, তার অল্প কিছুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো।

২ …

স্যামের সাথে ঘুটাঘুটি চলছিল অনেক অনেকদিন ধরে। এই বাধা, এই সমস্যা, ব্লা ব্লা অনেক কিছু ফানুসের মতো উড়ে গেলো পঁচিশে ফেব্রুয়ারীর কারণে। দুঃখজনক, অনাকাংখিত তবুও এটাই বাস্তব।

তারপর আমাদের সতেই মার্চ দেখা হলো। মেয়েদের পকেট ভর্তি সবসময়ই টাকা থাকে বোধ হয়। ও আমাকে দুইটা বই কিনে দিলো। শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্ণেল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা। যদিও দুইটা বইই ও কিনেছিল কিন্তু আমি ওকে “খোয়াবনামা” উপহার দেওয়ার অভিনয় করলাম, আর ও আমাকে সত্যি সত্যি দিলো “ক্রাচের কর্নেল”।

আমার বাংলা হাতের লেখা খারাপ ছিল। কিন্তু কলেজে যাবার পর যাদের হাতের লেখা সুন্দর, আমি তাদের বিভিন্ন অক্ষর অনুকরণ করতাম, তারা কীভাবে মাত্রা দেয় দেখতাম। এমন করতে করতে একদিন আমার হাতের লেখা সুন্দর হয়ে গেলো। আমি মানুষের ভালো জিনিস বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করতে পারি। স্যামের সাথে থাকার অন্যতম কারণ হলো এইটাই। দুই বছরের বেশি সময় ওর সাথে থেকে আমি দেখেছি আসলে ওর কাছ থেকে শেখার মতো অনেক অনেক কিছুই আছে। আমি খাদযুক্ত মানুষ, ওর সাথে থেকে থেকে ওর ভালো অভ্যাসগুলো রপ্ত করে বিশুদ্ধ হতে চাই।

আমাদের আড্ডার খুব প্রিয় একটা জায়গা বাউনিয়া। মাথার উপর দিয়ে প্লেন চলে যায় আর আমরা নানা বিষয় নিয়ে কথা বলি। ও কোনদিন সামান্যতম ময়লা যেখানে সেখানে ফেলেনি সেকথা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি দেশপ্রেমের কথা বলে মুখে ফেনা তুলেন- অথচ তার বাসায় স্যামরা যাবার পর আপ্যায়ন করা হলো পাকিস্তানি সেজান জুস দিয়ে। আর উপহার পাওয়া একটা জামার কাপড় যেটা পাকিস্তানী অফিসাররা দিয়েছিল বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে সেটা ও কখনো পরে না, অনেক মজা তবুও লেয়স চিপস খায়না। এসব কথা কিংবা পারতোপক্ষে অকথার ভীড়ে আমাদের মাথার চুল উড়িয়ে প্লেন যেতে থাকে। এমন সময় ও বলে উঠে- ওর খুব ইচ্ছে লারা হবার।

৩ …

লারা আমার স্মৃতিতে ছিল হাজারটা খবরের ভীড়ে একটা ছোট্ট খবর হয়ে- একজন বাংলাদেশি মহিলা পাইলট, বিমান দূর্ঘটনায় যে মৃত্যুবরণ করেছিল। খবরটা যখন শুনি তখন সবকিছু ছাপিয়ে আমার মনে প্রশ্ন হয়েছিল, আচ্ছা মেয়েটার নাম লারা কেন?

এই প্রশ্নের উত্তর পাই পরের দিন। স্যাম আমাকে লারার মা, সেলিনা হোসেনের লেখা “লারা” বইটা দেবার পর। জানতে পারি ব্রায়ান লারা নয়, লারার নাম রাখা হয়েছে “ডক্টর জিভাগো” উপন্যাসের নায়িকা লারার নামে। উপন্যাসের লারা যেমন পড়াশোনায় রাতদিন খাটতে পারে, তেমন শারীরিক কাজেও ওর জুড়ি নেই। পরিশ্রম ওর কাছে সহজ ব্যাপার। লারার সব কিছুর মধ্যেই সুষমা আছে, নান্দনিক বৈশিষ্ট আছে। এটা লারা’র মতো মেয়ের পক্ষেই সম্ভব।

সেলিনা হোসেনের লারা কিংবা আমাদের সবার লারাও তাই। স্বল্প সময় নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিল সে। পড়াশোনা করেছে, সাংবাদিকতা করেছে, এইডস নিয়ে প্রান্তিক এলাকায় কাজ করেছে, দোভাষি হয়ে টাকা উপার্জন করে সে টাকায় পাইলট প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে।

নানা দেশ ঘুরে, নানা কাজ করে সে জীবনটাকে ভীষণভাবে উপভোগ করেছে। পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ যা করার স্বপ্ন দেখেই দিন কাটিয়ে দেয়, সে সেই স্বপ্নগুলো ধুমধাম বাস্তবায়িত করেছে। তাই এয়ার পারাবতের কর্মকর্তাদের অবহেলায় এই মেয়েটা মরে যাবার পরও আমার তেমন একটা দুঃখ লাগে না, কারণ আমি জানি সে “ডক্টর জিভাগো”র লারার চেয়ে কোন অংশে কম তো নয়ই বরঞ্চ আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য একটা হিংসা, একজন দেবী। আমরা তার তিনগুন সময় পেলেও কোনদিন তারমতো হতে পারবো না।

তাও ভালো উপন্যাসটা পড়া হলো, তা না হলে লারা’র মতো একজন আমার কাছে “কেন তার নাম একজন ক্রিকেট খেলোয়াড়ের নামে?” হয়েই বেঁচে থাকতো আজীবন। এখন আমি লারা কে চিনি, তার স্বপ্নগুলোকে অনুভব করতে পারি … লারা বেঁচে থাকুক, আমাদের কতো অসংখ্য পাঠকের হৃদয়ে। এতোটুকু জায়গা তো আমরা তাকে দিতেই পারি, তাই না …

সিসিবিতে প্রকাশিত –


মন্তব্য করুন »

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

    গুগলান …

    মোর খোমা

    নিজের কথা নিজেই বলি

    গভীর সমুদ্রের মধ্যভাগের এক দ্বীপে আটকে থাকা একজন মানুষকে উদ্ধারের আশায় তীর থেকে ভাঙা তরী ভাসিয়ে তার মাঝে বসে থেকে চুরুট টানা মানুষ আমি। স্বপ্ন দেখি অনেক, অলসতায় যার প্রায় সবটুকু স্বপ্নই থেকে যায়।

    ইসলামী প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (আইইউটি) থেকে তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশলে স্নাতক। দেশের গরীব জনগনকে সল্পমূল্যে চিকিৎসা সরঞ্জাম পৌঁছে দেবার ইচ্ছায় গবেষণারত সিদ্দিক- ই- রব্বানী স্যারের সাথে কাজ করি এখন। গালভরা একটা নামও আছে অবশ্য এই কাজের। বায়োমেডিক্যাল ফিজিক্স এন্ড টেকনোলোজি বিভাগের পিএইচডি গবেষক (!!)।

    ব্লগজগতে আছি প্রায় তিনবছর। "বস" লেখক না হয়েও "বস" লেখকদের একটা স্বভাব এখন আমারও হয়েছে। লিখতে আর ভালো লাগেনা।

    বিষয়বস্তু

    গুঁতাশুমারি

    • 2,618 টি

    RSS ফিড

    RSS Feed